বাবা বাবা ডাকে রোজা, সে তো আর আসে না!

News News

Desk

প্রকাশিত: ৭:৫৮ অপরাহ্ণ, জুলাই ১৭, ২০২৫

অনলাইন ডেস্ক : ৮ মাস বয়সী রোজা আধো আধো বুলিতে প্রায়ই ডেকে ওঠে ‘বাবা! বাবা!’ কিন্তু তার সেই ডাকে সাড়া দেওয়ার কেউ নেই। সুযোগ পেলেই বাবার ছবি আঁকড়ে ধরে শিশুটি।

জুলাই অভ্যুত্থান চলাকালে ২০২৪ সালের ১৯ জুলাই শহীদ হন রোজার বাবা আল আমিন রনি।

রোজার মা মিম আক্তার বলেন, “আমার স্বামীর মৃত্যুর সময় রোজা আমার গর্ভে। মৃত্যুর আগে আমাদের সন্তানের নামও ঠিক করে রেখেছিলেন মিথিলা ইসলাম রোজা।

আজ আমাদের সন্তান বাবা ডাকটি বলতে পারলেও ওর বাবা তো আর আসে না! এই দুঃখ আমি কাকে বলব, ওকে কীভাবে বলব যে, ওর বাবা আর কোনোদিন ফিরে আসবে না!”

বরিশালের বানারীপাড়া উপজেলার সলিয়াবাকপুর পূর্ব বেতাল গ্রামের বাসিন্দা মেরিনা বেগম বড় ছেলে রনি ও ছোট ছেলে রহিমকে নিয়ে রাজধানীর মহাখালীর সাততলা বাউন্ডারি বস্তিতে থাকতেন।

২০২৩ সালে বানারীপাড়ার চাখার গ্রামের বাসিন্দা কামাল হোসেন মাঝির মেয়ে মিম আক্তারের সঙ্গে বিয়ে হয় রনির। বিয়ের কয়েকমাস পরে অন্তঃস্বত্ত্বা হওয়ায় মিম বাবার বাড়িতে চলে আসেন।

দিনের বেলায় রনি রাজধানী ঢাকার মহাখালীর একটি ওয়ার্কশপে কাজ করতেন। বাড়তি আয়ের জন্য রাতের বেলায় অনলাইনে খাবার বিক্রি করা একটি প্রতিষ্ঠানের খাবার সরবরাহের কাজ করতেন।

দিনে-রাতে এভাবে কাজ করে এ কে ফজলুল হক কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করা রনি বাবা মারা যাওয়ার পর সংসারের হাল ধরেন।

গত বছরের ১৯ জুলাই দুপুরে মহাখালীতে অবস্থানকালে বাম পাঁজরে গুলিবিদ্ধ হন রনি। রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হলে ২০ জুলাই রনিকে বানারীপাড়ায় এনে দাফন করা হয়।

রনির মৃত্যুতে তছনছ হয়ে যায় তার পুরো পরিবার। পৃথিবীতে আসার আগেই বাবাকে হারায় রোজা। স্বামী হারা হন মিম আক্তার আর উপার্জনক্ষম সন্তানকে হারান মা মেরিনা বেগম।

বর্তমানে ছোট্ট রোজা তার মায়ের সঙ্গে বানারীপাড়ার চাখারে নানাবাড়িতে থাকে। আর রোজার দাদি মেরিনা বেগম একাই থাকেন বানারীপাড়া উপজেলার সলিয়াবাকপুর পূর্ব বেতাল গ্রামে স্বামীর ভিটায়।

সেই ভিটার সামনের কবরস্থানে বাবা মৃত দুলাল হাওলাদারের পাশের কবরে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন শহীদ আল আমিন রনি। শহীদ রনির ছোট ভাই এখন সংসারের হাল ধরতে ঢাকায় থেকে ভাইয়ের ওয়ার্কশপেই চাকরি করছেন।

গ্রামের বাড়িতে গিয়ে রনির মাকে পাওয়া না গেলেও কথা হয় তার দাদি মরিয়ম বেগমের সঙ্গে। বাংলানিউজকে তিনি বলেন, “মোর পাঁচ পোলার একজনও নাই!

হেই পোলাগো মধ্যে দুলালের বড় পোলার নাম রনি। ও অনেক ভালো পোলা ছিল, মোর খোঁজ-খবর রাখতো, মাস শ্যাষ হইলেই টাহা পাডাইতে খাইতে।

এহন রনিও নাই খাইতেও কেউ দে না বাবা! শেষবার যহন রনি বাড়িতে গোনে গ্যাছে, তহনও আমার হাতে পাঁচশো টাহা দিয়া গ্যাছে।

স্থানীয়রা জানান, রনি খুব ভালো ছেলে ছিল। সে বাড়িতে এলে আশপাশের সবার খোঁজখবর নিতো। কারও সঙ্গে কখনও খারাপ ব্যবহার করেনি, মানুষের বিপদে-আপদেও পাশে থাকার চেষ্টা করেছে।

বাবাহারা নাতনি রোজার ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে মেয়ে মিম আক্তারের জন্য সরকারি একটি চাকরির দাবি জানিয়েছেন রনি শ্বশুর ক্ষুদ্র মৎস্য ব্যবসায়ী কামাল হোসেন মাঝি।

তিনি বলেন, “মেয়ে যখন গর্ভবতী তখনই আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসা হয়েছিল। প্রথম সন্তান তো তাই মেয়ের সেবাযত্ন আমরাই করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ভাগ্য আর মেয়েকে স্বামীর কাছে ফিরে যেতে দেয়নি।

নাতি ভূমিষ্ঠ হওয়া থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত লালনপালন আমরাই করছি। আমি ও আমার স্ত্রীর যতক্ষণ সাধ্য রয়েছে এই মেয়ে ও নাতির পাশে থাকব।

তবে ভালো হয় যদি মেয়ের একটা সরকারি চাকরি হয়। আমাদের বয়স হয়েছে, কখন কী হয়ে যায়! মেয়ে নিজের পায়ে দাঁড়ালে অন্যের দ্বারস্থ হতে হবে না।

তিনি আরও বলেন, রনির মৃত্যুর পর আমার মেয়ে অনেকটা নির্বাক হয়েগিয়েছিল। তারপরও নাতনি রোজার কথা চিন্তা করে আবার শক্ত হয়েছে।

মেয়ের ইচ্ছাতেই তাকে আবার অনার্সে চাখারের একে ফজলুল হক কলেজে ভর্তি করেছি। আমি চাই মেয়ের মতো আমার নাতনিও যেন পড়াশোনা করতে পারে।

কামাল হোসেন মাঝির স্ত্রী লুনা বেগম বলেন, কখনও ভাবিনি মেয়ে এত অল্প বয়সে স্বামীহারা হবে। মেয়েটা শোক বুকে আঁকড়ে ধরে দিন কাটাচ্ছে। তবে বাবার অনুপস্থিতি কোনোদিন পূরণ হবে না রোজার!

শহীদ রনির পরিবার জুলাই ফাউন্ডেশনের পাশাপাশি সরকারিভাবেও সহায়তা পেয়েছে। গর্ভবতী থাকাকালীন উপজেলা প্রশাসন ও স্বাস্থ্য বিভাগের সহায়তা পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন শহীন রনির স্ত্রী মিম আক্তার।

তিনি বলেন, “জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে পাওয়া পাঁচ লাখ টাকা সমান দুই ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। অর্ধেক আমি আর আমার মেয়ে পাচ্ছি আর বাকি অর্ধেক আমার শাশুড়ি পেয়েছেন।

আর সরকারিভাবে ১০ লাখ টাকার যে সঞ্চয়পত্র দেওয়া হয়েছে, সেখান থেকে মুনাফাও একইভাবে ভাগ করে নিচ্ছি আমরা।

প্রতি মাসে শাশুড়ি আমাদের বাড়িতে আসেন, নাতনি খোঁজখবর নেন। আমার স্বামী যে ওয়ার্কশপে কাজ করতো সেখানে আমার দেবরের চাকরি দিয়েছেন ওয়ার্কশপের মালিক।

শহীদ রনির স্ত্রী আরও বলেন, “আমার স্বামী কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত না থাকলেও কাজের ফাঁকে বন্ধুদের সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা নানান কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করতো।

প্রথম দিকে আমার স্বামীর অনুপস্থিতি আমাকে অনেক পীড়া দিত। তবে এখন নিজেকে বুঝাই—সবার মৃত্যু তো শহিদি মৃত্যু হয় না, আমার স্বামীর হয়েছে। আমি চাই শহীদের স্ত্রীর মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকতে, আর এটাই আমার শক্তি।

তিনি বলেন, সময় যত যাবে আমাদের সন্তান বড় হবে, ওর ভবিষ্যৎ চিন্তা করে পড়াশোনা শুরু করেছি, একটা চাকরিও খুঁজছি। এখন মুনাফা দিয়ে যে টাকা হাতে আসে, তা দিয়ে চলা কষ্টকর।

চাকরি হলে মা-মেয়ের জীবন ধারণ কিছুটা সহজ হবে। আমার অল্প উপার্জন করলেও সেখানে ভালো আছি। মা-বাবা আমার মেয়েকে খুশি রাখতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন।

মিম আক্তার আরও বলেন, আপনারা সবাই রনির জন্য দোয়া করবেন, তার সাথে যে টুকু স্মৃতি রয়েছে, সবটাই ভালো স্মৃতি। অনেক ভালো মানুষ ছিল।

সন্তান হওয়ার আগে বলেছিল, ছেলে হলে আলিফ আর মেয়ে হলে যেন তার নাম রোজা রাখি। আমি তার কথাই রেখেছি।