বিসিসি’র ভোট যুদ্ধে ঘরে-বাইরে খোকন সেরনিয়াবাতে’র একার লড়াই

News News

Desk

প্রকাশিত: ৯:২২ অপরাহ্ণ, মে ১২, ২০২৩

অনলাইন ডেস্ক : এইতো আর কদিন বাদেই অনুষ্ঠিত হবে বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচন (বিসিসি)। আওয়ামী লীগসহ যেসব দল থেকে প্রার্থীরা নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন, এক-পা দু-পা করে সবাই প্রচারণায় বের হচ্ছেন।

যদিও সবার চেয়ে এগিয়ে ছিল আওয়ামী লীগ, তথা মনোনীত প্রার্থী আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ; যিনি খোকন সেরনিয়াবাত নামে পরিচিত। কিন্তু সময় যত ঘানিয়ে আসছে খোকনের মাঠের আয়তন কমছে। বোঝা যাচ্ছে ভোট যুদ্ধে ঘরে বাইরে একাই লড়াই করতে হবে খোকনকে।

সিটি নির্বাচনের অগ্রিম প্রচারণা পর্ব সরেজমিনে লক্ষ্য রাখছে গণমাধ্যমকর্মীরা। দেখা যাচ্ছে, ভোটের দিন আসার আগে প্রার্থীদের ব্যাপক ব্যস্ততা। নানা কৌশলে নির্বাচনে মেয়র-কাউন্সিলর পদে অংশ নিতে চাওয়া প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করতেও দেখা যাচ্ছে। এখন পর্যন্ত মেয়র পদে নয় জনসহ ২১৬ জন প্রার্থী নির্বাচন কমিশন থেকে মনোনয়ন ফরম নিয়েছেন। এ পত্র দাখিল, বাছাই ও প্রতীক বরাদ্দ কার্যক্রম এখনও শুরু হয়নি, কিন্তু প্রার্থীরা আগেই ভোটারদের দরজায় যাচ্ছেন।

বিসিসি নির্বাচনে এবার সবচেয়ে বেশি আলোচিত পদটি মেয়রের। প্রার্থীরাও এবার শক্ত করে কোমর বেধেছেন। যে করেই হোক জয় তাদের চাই। আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি (জাপা), ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মনোনীত প্রার্থীরা তো মাঠে আছেনই, আলোচনায় উঠে এসেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী ও সাবেক ছাত্রদল নেতা কামরুল আহসান রূপণ। নিজ এলাকা মুহুর্মুহু প্রচারণায় চাঙা রেখেছেন তিনি।

বরিশাল নগরের সাধারণ ভোটাররা বলছেন, মেয়র পদে খোকনসহ আলোচিত চার প্রার্থীর মধ্যে ব্যাপক ভোট যুদ্ধ হবে। সবচেয়ে বেশি লড়াই হবে আওয়ামী লীগ-জাতীয় পার্টির মধ্যে; তারপর হয়ত আওয়ামী লীগ-ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মধ্যে। স্বতন্ত্র প্রার্থী সাবেক ছাত্রদল নেতা হলেও তিনি খুব বেশি আলোচনায় নেই। তবে যদি চমৎকার হয়, সে বিষয় ভিন্ন।

কিন্তু বরিশালের আওয়ামী লীগাররা বলছেন তাদের প্রার্থী খোকন সেরনিয়াবাতের সঙ্গে লড়াই জমবে মুফতি সৈয়দ মো. ফয়জুল করীমের। আবার সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা বলছেন ভিন্ন কথা। মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান মেয়র সাদিক আব্দুল্লাহর প্রত্যক্ষভাবে না থাকায় বিসিসি ভোট খোকনের জন্য কঠিন হয়ে পড়বে। আওয়ামী লীগের জয় পেতে হেভিওয়েট নেতাদের না পেয়ে তাকে কার্যত একাই ‘মুভ’ করতে হচ্ছে। ফলে বাইরে জাপা, ইসলামী আন্দোলন, রূপণসহ একাধিক স্বতন্ত্র প্রার্থীর সঙ্গে লড়াইটাও একাই করতে হচ্ছে খোকনকে।

এবার মনোনয়ন না পেয়ে সাদিক মন খারাপ করলেও বলেছেন চাচা খোকনকে সমর্থন দেবেন। কিন্তু দুটি ভিডিও কনফারেন্স করা ছাড়া খোকনকে তার প্রত্যক্ষ সমর্থন দিতে দেখা যাচ্ছে না। সাদিক অনুসারীরাও কার্যত অনুপস্থিত। ঘরের ভেতর এ দোলাচল সবচেয়ে বেশি ভাবাচ্ছে খোকনকে।

খোকন সেরনিয়াবাতের লড়াইটা কোথায়-

জাতীয় পার্টির প্রার্থী প্রকৌশলী ইকবাল হোসেন তাপস গত সিটি নির্বাচনেও অংশ নিয়ে নগরবাসীর কাছে ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছেন। সাদিকের কাছে হেরে গেলেও তিনি খোকনের চেয়ে বেশি জনপ্রিয়। আবার, বিগত সময় সিটি নির্বাচনে বিভিন্নজনকে প্রার্থী দিলেও এই প্রথম ‘হেভিওয়েট’ একজনকে মেয়র পদে দাঁড় করিয়েছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ।

দলটির সিনিয়র নায়েবে আমীর মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ ফয়জুল করীম বরিশালবাসীর কাছে বেশ সুপরিচিত, কর্মী-সমর্থকদের কাছেও নন্দিত। রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে ইসলামী আন্দোলন ফয়জুল করীমের ছোট ভাই ও দলের ছাত্র ও যুব বিষয়ক সম্পাদক মুফতি সৈয়দ এছহাক মুহাম্মাদ আবুল খায়েরের মনোনয়ন সংগ্রহ করে রেখেছে। কোনোভাবে ফয়জুল আটকে গেলে খায়ের বিসিসি নির্বাচনে প্রার্থী হবেন।

দলের মহানগরের নেতারা বলছেন, আওয়ামী লীগকে টেক্কা দিতে রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে তারা এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এবং এটি নিয়ে কোনো বিরোধ তাদের মধ্যে নেই। ইসলামী আন্দোলনের এমন ‘কঠিন’ সিদ্ধান্ত প্রমাণ করে, তারা ভোটের শেষ সময় পর্যন্ত নির্বাচনের মাঠে থাকবে।

এ ব্যাপারে খোকন সেরনিয়াবাতের অনুসারীদের ভিন্ন মত। তাদের দাবি, বরিশাল সিটিতে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের নায়েবে আমীর মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ ফয়জুল করীমকে মেয়র প্রার্থী হিসেবে ঘোষণার পেছনের কারণ ভিন্ন। বিগত সময়ে আওয়ামী লীগের যে পক্ষের সঙ্গে তার সম্পর্ক ভালো, তাদের সাপোর্টে আলোচনা না থেকেই ফয়জুল প্রার্থী হয়েছেন। যাদের কারণে এমন দিন দেখতে হচ্ছে, তারাই খোকন সেরনিয়াবাতের বিরোধিতা করছেন। এ ইঙ্গিত মূলত খোকনের ঘরের মানুষ সাদিকের দিকেই।

বিষয়টি নিয়ে নিজের মত প্রকাশ করেছেন বরিশাল নগরের ২০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর জিয়াউর রহমান বিপ্লব। তিনি বলেন, আমার সন্দেহ কোনো একটি গোষ্ঠী ফায়দা লুটতে ফয়জুল করীমকে প্রার্থী করেছেন। যদিও কোনো ষড়যন্ত্রেই কাজ হবে না। আমাদের সাংগঠনিক অবস্থান খুব ভালো। জয় খোকন সেরনিয়াবাতেরই হবে।

আওয়ামী লীগের ‘একটি অংশের সাপোর্টের’ বিষয়ে নিজের দাবি উপস্থাপন করেছেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মনোনীত মেয়র প্রার্থী মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ ফয়জুল করীম। তিনি বলেন, যারা এমন কথা বলছেন, তাদের এর ব্যাখ্যা ও প্রমাণ দিতে হবে। যদি কেউ বলে থাকে আওয়ামী লীগের একটি অংশ আমাকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করিয়েছে, এটা আমার জন্য পজিটিভ রিউমর। তারাই তো তাদের একদল আমাকে দিয়ে দিয়েছে, তাহলে আমার নির্বাচিত হতে আর কোনো সমস্যা নেই।

লোকমুখে ঘুরে ফেরা ‘চাচা-ভাতিজার বিভেদ’ বিষয়টিও স্থানীয় আওয়ামী লীগের পথে কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে বিবাদ প্রকাশ্যে এসেছে সেটির কারণে নির্বাচনী কার্যক্রম ব্যাহত হতে পারে বলেও অভিমত অনেকের। কারণ, দলীয় মনোনয়ন ঘোষণার পর থেকে মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সিটি মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ এখনও দলীয় প্রার্থীর পক্ষে নিজে অবস্থান নেননি।

আবার তার অনুসারী ও ঘনিষ্ঠজনরাও প্রার্থীর পাশে নেই। সাদিক ভিডিও কনফারেন্সে নৌকার প্রার্থীর পক্ষে তার অনুসারী নেতাদের কাজ করার নির্দেশ দিলেও বাস্তবে যারা পোস্ট-পজিশন ধরে রেখেছেন, তারা কেউই খোকনের পক্ষে সরব না। খোকন সেরনিয়াবাতের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য ও মহানগর ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক অসীম দেওয়ান এ দাবি করেছেন।

আবার সাবেক মেয়র প্রয়াত শওকত হোসেন হিরণের ঘনিষ্ঠজন ও আওয়ামী লীগের প্রার্থী খোকন সেরনিয়াবাতের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য এবং বিএম কলেজের ভিপি মঈন তুষার মনে করেন, দলের মধ্য থেকে ষড়যন্ত্র করে শওকত হোসেন হিরণকে যেভাবে হারানো হয়েছিল, খোকনের বেলায় সেটা না হয় তাহলে তার বিজয় সুনিশ্চিত।

এদিকে, ৩১ সদস্য বিশিষ্ট নির্বাচন প‌রিচালনা উপদেষ্টা কমিটি করেছেন খোকন সেরনিবাত। আছে ১৬ সদস্য বিশিষ্ট নির্বাচন পরিচালনা কমিটিও। তিনি এসব কমিটিতে বর্তমানদের পাশাপাশি সাবেক আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগ, যুবলীগ নেতাদের রেখেছেন। কিন্তু বাদ পড়েছেন সাদিক আব্দুল্লাহ ও তার অনুসারীরা। উপদেষ্টা কমিটির তালিকায় আবার সবার ওপরে রয়েছে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আলহাজ্ব আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ অর্থাৎ তার বড় ভাইয়ের নাম। বিষয়টি নিয়েও আওয়ামী লীগের নানা জনে বিতর্ক রয়েছে।

সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ বরিশাল সিটি করপোরেশনের মেয়র হওয়ায় তাকে নির্বাচন পরিচালনা বা উপদেষ্টা কমিটিতে রাখা সম্ভব হয়নি বলে দাবি করেছেন খোকন সেরনিয়াবাত। আর নিজের অনুসারীদের বিষয়ে তার সাফ কথা, ‘নির্বাচন পরিচালনা কমিটিতে কাকে রাখা হবে সেটি আমার ব্যক্তিগত বিষয়। ’

সার্বিক বিষয়ে নগরের ভোটাররা বলছেন, বর্তমান যে পরিস্থিতি তাদের সামনে, নৌকা প্রতীকের প্রার্থীকে নিজের ঘর ও বাইরে একাই লড়তে হচ্ছে। জাতীয় পার্টি, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, জাকের পার্টির প্রার্থীর সঙ্গে তার নির্বাচনী যুদ্ধ কঠিন। আবার বিএনপি ঘরানার স্বতন্ত্র প্রার্থী রুপনসহ একাধিক প্রার্থীর সঙ্গেও হিসেবটা খারাপ হবে না। আবার প্রার্থী না দিলেও নগরে থাকা জামায়াতে ইসলামির ভোটের দিকটাও খোকনকে বিবেচনা করতে হবে। সব মিলিয়ে বিসিসির ভোট খোকনের জন্য কঠিন হতে চলেছে।

সূত্র : বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম