আজ থেকে দিনে এক-দুই ঘণ্টা লোডশেডিং News News Desk প্রকাশিত: ৮:১৯ পূর্বাহ্ণ, জুলাই ১৯, ২০২২ অনলাইন ডেস্ক : বিশ্ববাজারে অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে জ্বালানি সাশ্রয়ে মঙ্গলবার (১৯ জুলাই) থেকে দেশজুড়ে এলাকাভিত্তিক এক থেকে দুই ঘণ্টা পর্যন্ত লোডশেডিংয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এছাড়া সপ্তাহে এক দিন বন্ধ থাকবে সারা দেশের সব পেট্রোল পাম্প। তবে কোন দিন বন্ধ থাকবে তা এখনো ঠিক করা হয়নি। পেট্রোল পাম্প মালিক সমিতির নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে তা নির্ধারণ করা হবে। সংকট না কাটা পর্যন্ত ডিজেলভিত্তিক সব বিদ্যুৎকেন্দ্রও বন্ধ থাকবে। এতে ২০ শতাংশ ডিজেল সাশ্রয় হবে বলে মনে করছে সরকার। এছাড়া সরকারি-বেসরকারি অফিসের সভা ভার্চুয়ালি করা হবে। অফিসের কর্মঘণ্টাও এক থেকে দুই ঘণ্টা এগিয়ে আনা হবে। গতকাল সোমবার সকালে রাজধানীর তেজগাঁওয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে বিদ্যুৎ ও জ্বালানিবিষয়ক সমন্বয় সভায় এসব সিদ্ধান্ত হয়। তবে এসব তৎপরতায় পরিস্থিতির খুব একটা উন্নতি হবে না বলে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) একাধিক প্রকৌশলী দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছেন। তারা বলেছেন, ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো গত তিন বছর ধরে টানা বন্ধ রাখা হয়েছে। ফলে নতুন করে এসব কেন্দ্র বন্ধ করে জ¦ালানি সাশ্রয়ের সুযোগ নেই। আমদানি করা তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) সরবরাহ বাড়ানো না গেলে একমাত্র বৃষ্টিই সংকট দূর করতে পারে। কারণ সারা দেশে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণযন্ত্রে (এসি) প্রতিদিন ৩ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ব্যবহার হয়, বৃষ্টি হলে এসি চালানোর তেমন একটা দরকার পড়বে না। ফলে এই পরিমাণ বিদ্যুৎ সাশ্রয় হবে। দেশে বর্তমানে পিক-আওয়ারে (সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত) গড়ে প্রায় ১৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের প্রয়োজন হয়। মোট ২২ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার মধ্যে গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক হলে পিক-আওয়ারের চাহিদার এই বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারবে পিডিবি। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, সারা দেশে ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ থাকলে ১ হাজার থেকে ১ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সাশ্রয় হবে। এতে দিনে এক থেকে দুই ঘণ্টা লোডশেডিং হবে। তবে পিডিবির প্রকৌশলীরা বলছেন ভিন্ন কথা। তারা জানান, ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র গত তিন বছর ধরে টানা বন্ধ রাখা হয়েছে। কারণ ডিজেলে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ গড়ে ২৪ টাকা ছিল, যা এখন বেড়ে ৩৭ টাকা হয়েছে। এ কেন্দ্রগুলো নতুন করে বন্ধ করার কিছু নেই। তাই ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে জ্বালানি সাশ্রয় করারও সুযোগ নেই। পিডিবির প্রকৌশলীরা আরও জানান, দেশে বিদ্যুতের চাহিদার প্রায় ৫২ শতাংশই আসে মূলত গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে। এ বিদ্যুৎ কম দামে পাওয়া যায়। আর ভারত থেকে আসে চাহিদার পাঁচ শতাংশের কিছু বেশি। বিদেশ থেকে আমদানি করা এলএনজির দাম বেড়ে যাওয়ায় সরকার আমদানি কমিয়ে দিয়েছে। দেশে এই মুহূর্তে ২২ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার মধ্যে সন্ধ্যার পিক-আওয়ারে সর্বোচ্চ ১৪ হাজার মেগাওয়াট হলেই নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করা সম্ভব। গ্যাস সরবরাহ বন্ধ থাকায় গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদন কমে সাড়ে চার হাজার মেগাওয়াটে দাঁড়িয়েছে। এ পরিস্থিতি সহসাই পরিবর্তন হবে না। ফলে বিদ্যুতের প্রকৃত ঘাটতি ১ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট নয়, এটি অন্তত আড়াই হাজার মেগাওয়াট। আর দিনে শুধু এক থেকে দুই ঘণ্টা লোডশেডিং নয়, এটি আরও বাড়বে বলে মনে করছেন পিডিবির প্রকৌশলীরা। সারা দেশে মঙ্গলবার (১৯ জুলাই) থেকে এলাকাভেদে লোডশেডিং শুরুর আগে গতকাল রাজধানী ঢাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহকারী দুই প্রতিষ্ঠান ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ডিপিডিসি) এবং ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেড (ডেসকো) তাদের বিতরণ এলাকায় লোডশেডিংয়ের সময়সূচি নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেছে। তবে দেশের সব থেকে বড় বিতরণ সংস্থা পল্লী বিদ্যুৎসহ বাকি বিতরণ সংস্থাগুলো লোডশেডিংয়ের সুনির্দিষ্ট সময়সূচি প্রকাশ করেনি। ডিজেলভিত্তিক কেন্দ্র বন্ধ থাকলে বাস্তবে কতটুকু সাশ্রয়? প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের বৈঠকে তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বলেন, ‘খরচ কমাতে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদন সাময়িক বন্ধ থাকবে। আমাদের ধারণা, এক থেকে দেড় হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের ঘাটতি হবে। এতে দিনে এক থেকে দেড় ঘণ্টা এবং কোনো কোনো জায়গায় দুই ঘণ্টাও লোডশেডিং হতে পারে। কিন্তু দেশের বৃহত্তর স্বার্থে এবং পৃথিবীর এই দুর্যোগপূর্ণ সময়ে আমাদের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।’ তবে পিডিবির দেওয়া তথ্য বলছে ভিন্ন কথা। পিডিবির তথ্য অনুযায়ী, দেশে ১০টি ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে। এই বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সম্মিলিত উৎপাদন ক্ষমতা ১ হাজার ২৯০ মেগাওয়াট। যে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো গত তিন বছর এমনিতেই উৎপাদন না করে বসেছিল। কারণ ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে গড়ে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম ২৪ টাকা পড়ত। আর এখন সেটি গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৩৭ টাকা। ফলে পিডিবি এমনিতেই এই বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বন্ধ রেখেছে সারা বছর। লোডশেডিং দিয়ে জ¦ালানি সাশ্রয় করার জন্য এই বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রাখলে নতুন করে কোনো জ¦ালানি সাশ্রয় হবে না। পিডিবির ২০২০-২১ অর্থবছরের আর্থিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, দেশে ২২ হাজার মেগাওয়াট স্থাপিত ক্ষমতার মধ্যে ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎ ছিল ১ হাজার ২৯০ মেগাওয়াট বা ৫.৮৬ শতাংশ। ওই অর্থবছরে সারাটা সময় জুড়ে দেশে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছিল ৮ কোটি ৪ লাখ ২৩ হাজার মেগাওয়াট। এর মাত্র দশমিক ৭৬ শতাংশ এসেছে ডিজেল থেকে। গত বছর সবচেয়ে বেশি বিদ্যুৎ এসেছে গ্যাসিভিত্তিক কেন্দ্র থেকে, যা মোট বিদ্যুতের ৫১.৯৭ শতাংশ। এরপরই ফার্নেস তেল থেকে ২৭.২৫ শতাংশ, কয়লা থেকে ৮.০৩ শতাংশ, ভারত থেকে আমদানি করা ৫.২৭ শতাংশ, জলবিদ্যুৎ থেকে ১.০৪ শতাংশ ও সৌরবিদ্যুৎ থেকে এসেছে ০.৫৯ শতাংশ। সরকার কী বলছে? প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বলেন, ‘খরচ কমাতে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদন আজ থেকে সাময়িক বন্ধ থাকবে। এ সিদ্ধান্ত সাময়িক। বিশ্ব পরিস্থিতির বদল হলে আগের অবস্থানে ফিরে আসা হবে। জ্বালানি উপদেষ্টা বলেন, ‘পৃথিবীতে একটা যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছে। ইউক্রেনের যে যুদ্ধ, সে যুদ্ধ কিন্তু আমাদেরও যুদ্ধ। ওই যুদ্ধের প্রভাব পড়ছে আমাদের ওপর।’ তিনি আরও বলেন, ‘যাদের অর্থের অভাব নেই, তারাও কিন্তু লোডশেডিং করছে। যুক্তরাজ্যে হচ্ছে, অস্ট্রেলিয়ায় হচ্ছে। উৎপাদনকে কমিয়ে খরচ যাতে সহনশীল হয়, সে পর্যায়ে নিয়ে আসার চেষ্টা করছি। ডিজেলের বিদ্যুৎ উৎপাদন আপাতত স্থগিত করলাম, তাতে অনেক টাকা সাশ্রয় হবে। মনে রাখতে হবে, ডিজেলের দাম আকাশচুম্বী হয়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে হওয়া সভায় বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে সরকারি-বেসরকারি অফিস ভার্চুয়ালি করারও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সরকারি অফিসগুলোয় কীভাবে কাজ করার সময় কমিয়ে আনা যায়, সেটাও ভাবা হচ্ছে বলে জানান প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব আহমদ কায়কাউস। বৈঠকে জানানো হয়, সরকারি অফিসগুলো ভার্চুয়ালি পরিচালনার বিষয়টি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সমন্বয় করবে। এদিকে কোন এলাকায় কখন লোডশেডিং হবে, তা আগে থেকে গ্রাহককে জানিয়ে দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। এ প্রসঙ্গে গতকাল সচিবালয়ে নিজ দপ্তরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছি শিল্প খাতকে। আগামী এক সপ্তাহে এক থেকে দুই ঘণ্টা লোডশেডিং দেওয়া হবে। পরে পরিস্থিতি বুঝে ভিন্নরকম সিদ্ধান্ত নেওয়া হতে পারে। প্রতিমন্ত্রী আরও বলেন, ‘এখন থেকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত সারা দেশে এক দিন পেট্রোল পাম্প বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তবে কীভাবে, কোন পদ্ধতিতে বন্ধ রাখা হবে, সেটা পরে জানানো হবে। বন্দর এলাকায় সপ্তাহে দুদিন পেট্রোল পাম্প বন্ধ রাখা হতে পারে বলেও জানান তিনি। নামাজের সময় বাদে অন্যান্য সময় মসজিদে এসি বন্ধ থাকবে জানিয়ে নসরুল হামিদ বলেন, ‘একই নিয়ম প্রযোজ্য হবে অন্যান্য ধর্মের উপাসনালয়ের ক্ষেত্রেও। অর্থাং শুধু প্রার্থনা বা ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের সময় এসি চালানো যাবে। এছাড়া রাত ৮টার পর দোকানপাট, বিপণিবিতান বন্ধ রাখার পুরনো সিদ্ধান্ত কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা হবে বলেও জানা গেছে। এসি ব্যবহারেই সাড়ে তিন হাজার মেগাওয়াট : সারা দেশে প্রতিদিন এসিতে প্রায় ৩ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ খরচ হয়। এ বিদ্যুৎ ধনীরা ব্যবহার করে থাকেন। সরকার সংকটকালীন সময় এসির তাপমাত্রা ২৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে রাখার নির্দেশ দিয়েছে। এ বিষয়ে বিদ্যুৎ বিভাগের নীতি প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, ‘এসি একটি বিলাসী পণ্য। জ্বালানি নিয়ে সারা দুনিয়া একটা সংকটের মধ্যে রয়েছে। এই বৈশ্বিক সংকট জাতীয়ভাবে মোকাবিলা করার জন্য কিছু ব্যবস্থা নিয়েছে সরকার। এর মধ্যে রয়েছে জ্বালানি সাশ্রয়ের জন্য লোডশেডিং করা। ২০১০ সালে আমরা লোড ম্যানেজমেন্ট করে তখন বিদ্যুৎ সরবরাহ করেছি। এখন আমরা দুই ঘণ্টা লোডশেডিং মেনে নিতে পারব। দেশের সংকট মোকাবিলায় এটা আমাদের সবাইকে মেনে নিতে হবে। সূত্র : দেশ রূপান্তর SHARES অর্থনৈতিক বিষয়: