সুন্দরবন বিগত ২২ বছরে আগুনে পুড়েছে ২৫ বার News News Desk প্রকাশিত: ১:৫৪ অপরাহ্ণ, মে ৫, ২০২৪ অনলাইন ডেস্ক : দাউ দাউ করে আগুনে পুড়ছে সুন্দরবন। সুন্দরবন বিগত ২২ বছরে অন্তত ২৫ বার আগুনের লেলিহান শিখায় পুড়েছে। সর্বশেষ শনিবার (০৪মে) বিকাল পৌনে তিন টায় সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের আমরবুনিয়া এলাকায় আগুন লাগে। রোববার (০৫ মে) সকাল ৮ টায় ফায়ার সার্ভিসের ৩টি ইউনিট আগুন নেভানোর কাজ শুরু করেছে। পুলিশ, উপজেলা প্রশাসন, বনরক্ষী ও স্থানীয় বাসিন্দারা অংশগ্রহণ করেছে বনরক্ষার কাজে। সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) কাজী মুহাম্মদ নুরুল করিম বলেন, সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের আমরবুনিয়া এলাকায় আগুন নির্বাপণে রোববার সকাল কাজ শুরু করা হয়েছে। অগ্নিকাণ্ডের কারণ ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানতে এসিএফ চাঁদপাইকে প্রধান করে তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। স্টেশন কর্মকর্তা ধানসাগর ও স্টেশন কর্মকর্তা জিউধারাকে নিয়ে গঠিত ৩ সদস্যের ওই কমিটিকে ৭ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। আগুন নিভোনোর পর তদন্ত কমিটি কাজ শুরু করবে। সুন্দরবনের অগ্নিকাণ্ডের অধিকাংশ ঘটনাই ঘটেছে বনের শরণখোলা ও চাঁদপাই রেঞ্জে। খুলনা ও সাতক্ষীরা রেঞ্জে কখনও আগুন লাগেনি। সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ২০০২ সালে সুন্দরবনের পূর্ব বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের কটকায় একবার, একই রেঞ্জের নাংলী ও মান্দারবাড়িয়ায় দু’বার, ২০০৫ সালে পচাকোড়ালিয়া, ঘুটাবাড়িয়ার সুতার খাল এলাকায় দু’বার, ২০০৬ সালে তেড়াবেকা, আমুরবুনিয়া, খুরাবাড়িয়া, পচাকোড়ালিয়া ও ধানসাগর এলাকায় পাঁচবার, ২০০৭ সালে পচাকোড়ালিয়া, নাংলি ও ডুমুরিয়ায় তিনবার, ২০১০ সালে গুলিশাখালীতে একবার, ২০১১ সালে নাংলীতে দু’বার, ২০১৪ সালে গুলিশাখালীতে একবার, ২০১৬ সালে নাংলী, পচাকোড়ালিয়া ও তুলাতলায় তিনবার, ২০১৭ সালে মাদ্রাসারছিলায় একবার এবং ২০২১ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি ধানসাগর এলাকায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ২০২১ সালের ৩ মে (সোমবার) পূর্ব সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের দাসের ভারানি এলাকায় আগুন লাগে। ফায়ার সার্ভিস, বন বিভাগ ও স্থানীয়দের প্রায় ৩০ ঘণ্টার প্রচেষ্টায় মঙ্গলবার (৪ মে) বিকেল ৫টায় আগুন নিভে যায়। পরবর্তীসময়ে বুধবার (৫ মে) সকালে আগের অগ্নিকাণ্ডের দক্ষিণ পাশে আবারও আগুন লাগে। সুন্দরবনের সবক’টি আগুনের ঘটনাই শুষ্ক মৌসুমে। প্রতিবার আগুন লাগার কারণ, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ও পরবর্তী সময়ে এ ধরনের ঘটনা এড়াতে তদন্ত কমিটি গঠন করে বন বিভাগ। তদন্ত কমিটি নির্দিষ্ট সময়ে সুপারিশসহ রিপোর্টও পেশ করে। তবে সেসব থেকে যায় ফাইলবন্দি। সেই সুপারিশগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- ৪০ কিলোমিটার খাল ও তিনটি পুকুর পুনঃখনন, আগুন লাগলে তা নিয়ন্ত্রণে বন বিভাগের জনবল বাড়ানো, বনরক্ষীদের টহল কার্যক্রম জোরদার, তিনটি পর্যবেক্ষণ টাওয়ার তৈরি, সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের ৩৫ কিলোমিটার এলাকায় নাইলনের দড়ি দিয়ে বেড়া নির্মাণ, রিভার ফায়ার স্টেশন নির্মাণ ও বনসংলগ্ন ভরাট হয়ে যাওয়া ভোলা নদী খনন করা। সুন্দরবন বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০০২ সাল থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে এ নিয়ে ২৫ বার আগুন লাগার ঘটনা ঘটলো। বন বিভাগের হিসাবমতে, বিগত ২৪ বারের আগুনে ৭১ একর ৬৬ শতাংশ বনভূমির ক্ষতি হয়। এর আর্থিক মূল্য ১৮ লাখ ৫৫ হাজার ৫৩৩ টাকা। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে আগুন লাগার কারণ হিসেবে মৌয়ালীদের ব্যবহৃত আগুনের কুণ্ডলী, জেলেদের সিগারেট, দাবদাহ, অনাবৃষ্টি, খরা, বন অপরাধে সাজাপ্রাপ্তদের প্রতিশোধমূলক আচরণ, দুষ্কৃতকারীদের দিয়ে বনের মধ্যে আগুন ধরানোকে দায়ী করা হয়। আগুনের স্থায়িত্বের কারণ হিসেবে বিভিন্ন গাছের পাতার পুরু স্তরকেও দায়ী করেছে তদন্ত কমিটি। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি অ্যান্ড উড টেকনোলজি ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক ড. মো. ওয়াসিউল ইসলাম বলেন, ধারণা করা হয় মৌয়ালদের (যারা বন থেকে মধু সংগ্রহ করেন) মশালের কারণে সুন্দরবনে আগুন লেগে থাকতে পারে। অথবা কারো বিড়ি সিগারেটের আগুন ফেলে রাখা থেকে আগুন ধরতে পারে। তুলনামূলক বনের যেসব এলাকায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে সেসব এলাকা অনেক উঁচু। গ্রীষ্ম মৌসুম চলায় অনেকদিন বৃষ্টি না হওয়া ও শুকনো পাতা জমে যাওয়ার কারণে আগুন অনেকক্ষণ জ্বলছে। বন বিভাগের আগুন লাগলে তাত্ক্ষণিক সাড়া দেয়ার মতো যন্ত্রপাতি ও জনবল নেই। ফলে স্থানীয় ফায়ার স্টেশন ঘটনাস্থলে পৌঁছতে পৌঁছতে আগুন বহুদূর ছড়িয়ে যায়। এতে বনে ক্ষতি হয় বেশি। অগ্নিকাণ্ড থেকে সুন্দরবনকে সুরক্ষিত রাখা এখন সময়ের দাবি বলে মন্তব্য করেন তিনি। সুন্দরবন গবেষক জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. এম এ আজিজ বলেন, সুন্দরবনের যে জায়গায় আগুন লেগেছে জায়গাটি তুলনামূলকভাবে উঁচু। ফলে এলাকায় জোয়ারের পানি সাধারণত ওঠে না। এতে করে সেখানকার বনতল সব সময় শুকনো থাকে এবং পাতা পড়ে আগুন লাগার একটা ঝুঁকি তৈরি হয়। ইতিপূর্বেও আমরা এখানে আগুন লাগার ঘটনা দেখেছি। আর আগুন লাগলে যেমন বনের ক্ষতি তেমনি বন্যপ্রাণীর উপর নেতিবাচক প্রভাব পরে। সুন্দরবন একাডেমির পরিচালক ফারুক আহমেদ বলেন, বলতে গেলে সম্প্রতি প্রায় প্রতিবছরই কম-বেশি সুন্দরবনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। এতে পুড়ছে বন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বন্যপ্রাণী। বনবিভাগ সুন্দরবনের অগ্নিকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে পারেনি। এমনকি আগুন নেভানোর জন্য বনবিভাগকে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত কোনো জনবল তৈরি করতে সক্ষম হয়নি। বন আইন বা বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন ২০১২ অনুযায়ী সংরক্ষিত বনাঞ্চলে আগুন দেওয়ার বিরুদ্ধে আইনি বিধান থাকলেও বিগত বছর এসব আইনে তেমন কেউ সাজা পায়নি। সুন্দরবন একটি জাতীয় সম্পদ হলেও সরকার বিষয়টিকে অধিক গুরুত্বের সাথে দেখছে না বলে অভিযোগ তোলেন তিনি। শরণখোলার সুন্দরবন সুরক্ষা কমিটির আহ্বায়ক নজরুল ইসলাম আকন বলেন, সুন্দরবনের যে এলাকায় আগুন লেগেছে সে এলাকায় আমি সরেজমিনে গিয়েছিলাম। বনের ওই এলাকায় আশেপাশে কোন জনবসতি নেই। তবে বনের এই অংশে মধুর চাক রয়েছে। মৌয়ালদের যাতায়াত রয়েছে। তবে কিভাবে কি কারনে আগুন লেগেছে তা এখন বলা সম্ভব না। সূত্র : বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম SHARES জাতীয় বিষয়: